বদরুদ্দীন উমর
ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান মুসলিম প্রধান দেশ। এসব দেশে জর্জ ডব্লিউ বুশ একনীতি এবং লাইনই অনুসৃত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আফগান যুদ্ধকে এখন পাকিস্তানে টেনে এনে, তার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে, সেখানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব দেশে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির আরও বিস্তার ঘটেছে। কাজেই প্রেসিডেন্ট ওবামাকে শান্তির দূত অথবা সাম্রাজ্যবাদের গোলাম পরিত্যাগকারী জনগণের পরিত্রাতা মনে করা রাজনৈতিক মূঢ়তা ও বালখিল্যতা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মধ্যপ্রাচ্যে সউদি আরব সফর শেষে মিসরে গিয়ে ৪ জুন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রতি তার এক নীতিনির্ধারণী বক্তৃতা দিয়েছেন। এই বহু প্রত্যাশিত বক্তৃতায় তিনি তার পূর্বসূরি জর্জ ডব্লিউ বুশের আগ্রাসী নীতির পরিবর্তে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন নমনীয় কৌশল উপস্থিত করার চেষ্টা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা বললেও এ কাজ যে আসলে দুই বিবদমান পক্ষকেই করতে হবে, একথা বলে তিনি তাদের প্রতি এ মর্মে আহ্বান জানিয়েছেন। ওবামা তার মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে মুসলিম দেশগুলো ও তাদের জনগণের প্রতি যে এই শান্তির আহ্বান জানাবেন এ কথা আগে থেকেই প্রচার করা হয়েছিল। তিনি যে ইসরাইলকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা ও তাকে স্বীকৃতি প্রদানের কথা এবং সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের ইসরাইল রাষ্ট্র স্বীকার করে নেয়ার জন্যও আহ্বান জানাবেন, এটাও ছিল জানা কথা। অন্তত মার্কিন সরকারি বক্তব্য ও তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোর রিপোর্ট থেকে সেটাই প্রেসিডেন্ট ওবামার মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগে বলা হয়েছিল। যা এভাবে প্রচার করা হয়েছিল, সেই মতোই প্রেসিডেন্ট ওবামা তার কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় বলেছেন। ওবামা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে অনেকের মধ্যে একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রশাসন পূর্ববর্তী রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন নীতিকে উল্টে দিয়ে সমস্ত পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে একটা সম্পূর্ণ পরিবর্তন সাধন করবেন। প্রেসিডেন্ট ওবামার কায়রো বক্তৃতার পর এ ধারণা অনেকের মধ্যে বেশ জোরদার হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওবামার পররাষ্ট্রবিষয়ক নানা বক্তব্য ও তার কায়রো বক্তৃতার মধ্যে এমন কিছু উপাদান দেখা যাচ্ছে না যাতে এ ধারণার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এটা হতেও পারে না। কারণ একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির মধ্যে আমূল বা বড় ধরনের পরিবর্তন এমনকি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, শুধু ব্যক্তি পরিবর্তনের মাধ্যমে হয় না। এমনকি আমেরিকার মতো দেশে শাসক শ্রেণীর দুই দলের মধ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যমেও সেটা সম্ভব নয়। একথা ভুললে চলবে না যে, বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সব থেকে বৃহৎ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও কর্ণধার। এই সাম্রাজ্যবাদীরা এমন কাউকে নির্বাচিত করতে পারেন না যাতে তারা নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বিশ্বে শান্তি স্থাপনের জন্য ব্যস্ত হতে পারেন। কাজেই মার্কিন পুঁজিপতিরা এমন একজনকে সমর্থন করেছেন যিনি বুশের থেকে যোগ্যতরভাবে তাদের স্বার্থ দেখাশোনা করতে পারেন। এ কাজটি করতেই প্রেসিডেন্ট ওবামা এখন নিযুক্ত হয়েছেন। তার আমলে তিনি সব থেকে উল্লেখযোগ্য যে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন সেটা হল, কূটনীতির ক্ষেত্রে কৌশলগত পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের একটি দিক হল, বাহ্যিক নমনীয়তা। বুশের চরম বর্বর চরিত্র এবং তার ঔদ্ধত্যের স্থানে বারাক ওবামার ব্যক্তিগত সুসভ্য আচরণ এবং ঔদ্ধত্যের পরিবর্তে নমনীয়তা স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মনে এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে যে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এমন পরিবর্তন হতে যাচ্ছে যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিবর্তন করে তাদের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোকে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা ও তাদের জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং সমৃদ্ধির জন্য এগিয়ে আসবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দেয়া এবং মুসলমানদের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত আচরণের কথা বললেও তিনি ফিলিস্তিন প্রশ্নে এমন কোন রাস্তা বাতলাতে পারেননি যার ভিত্তিতে সে অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের পথ এখনই বা অল্পদিনের মধ্যেই সুগম ও প্রশস্ত হতে পারে। তিনি একদিকে ইসরাইলকে সংযত হতে বলেছেন, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাস পরিত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যেভাবে একথা বলেছেন, তাতে মনে হয় না যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল হচ্ছে সব থেকে মারাত্মক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র এবং তাদের সাহায্য লাভ করেই তারা মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি ১৯৪৮ সাল থেকেই তৈরি করে রেখেছে। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসকে তারা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছেন। কিন্তু ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের সব থেকে বড় সন্ত্রাসবাদী তাণ্ডব হওয়া সত্ত্বেও সে বিষয়ে তার কোন বক্তব্য নেই। তিনি শুধু তাদের বলেছেন, ফিলিস্তিনিকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া এবং ফিলিস্তিনের যেসব অঞ্চল তারা দমন করে রেখেছে সেগুলোতে নতুন করে বসতি স্থাপন বন্ধ করার কথা। তিনি আরও বলেছেন, মুসলমানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের যে পরিবর্তনই হোক, ইসরাইলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কোন পরিবর্তন হবে না। এটাই স্বাভাবিক, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের স্বার্থে ইসরাইলকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে ব্যবহারের প্রয়োজন এখনও থাকলেও মার্কিন প্রশাসনের ওপর সেদেশের জায়নিস্ট বা ইসরাইল সমর্থন ইহুদি লবির চাপ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। এ কারণে ওবামা তার এই মধ্যপ্রাচ্য সফর শুরুর আগে জায়নিস্ট লবির সঙ্গে তার প্রশাসনের লোকদের এক বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন। ইসরাইলের প্রয়োজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যতই থাকুক, সেটা ছাড়া ইসরাইলের শক্তির সব থেকে বড় জোগান আসে আমেরিকায় জায়নিস্ট লবি থেকে। এই জায়নিস্টরাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও সংবাদ মাধ্যম বেশ শক্তিশালীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ওবামা তার কায়রো বক্তৃতায় ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাস বন্ধ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের তারা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছেন। কিন্তু হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা অঞ্চলে ইসরাইল যেভাবে নিয়মিত মিশাইল ও কামান আগ্রাসন করে শত শত শিশু-বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ হত্যা করছে, যেভাবে সেখানে তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে তাদের উদ্বাস্তুতে পরিণত করছে, এ বিষয়ে ওবামার বক্তৃতায় কিছু নেই। এই ফ্যাসিস্ট আক্রমণ বন্ধ করার জন্য ইসরাইলকে কোন পরামর্শ নেই। এর থেকেই প্রেসিডেন্ট ওবামার শান্তি মিশন ও শান্তির উদ্যোগের প্রকৃত চরিত্র বোঝার কোন অসুবিধে নেই। শান্তির শর্ত যে সিরিয়ার গোলান হাইটস থেকে ইসরাইলের সরে আসা অর্থাৎ সিরিয়ার এলাকা সিরিয়াকে ফিরিয়ে দেয়া, পশ্চিমতীর থেকে ইসরাইলের নিজেকে প্রত্যাহার করা, এসব কোন কথা ওবামার বক্তৃতায় নেই। কাজেই মুসলমানদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত নেই এবং তারা শান্তি চান, একথা বলে এবং কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দিলেই মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া ইসরাইল কর্তৃক অধিকৃত এলাকা থেকে সরে আসার কথাও ইসরাইলের সন্ত্রাস সম্পর্কে কিছু না বলে হামাসকে ও সাধারণভাবে ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাস পরিত্যাগের কথা বলে তিনি ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আগেই বলা হয়েছে, জর্জ ডব্লিউ বুশ ও বারাক ওবামার প্রশাসনের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্যের প্রশ্ন ওঠে না। পার্থক্য যা আছে সেটা শুধু এ দুয়ের কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে। প্রকাশ্য ঔদ্ধত্যের পরিবর্তে, বাহ্যিক নমনীয়তার মধ্যে। ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান মুসলিম প্রধান দেশ। এসব দেশে জর্জ ডব্লিউ বুশ একনীতি এবং লাইনই অনুসৃত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আফগান যুদ্ধকে এখন পাকিস্তানে টেনে এনে, তার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে, সেখানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব দেশে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির আরও বিস্তার ঘটেছে। কাজেই প্রেসিডেন্ট ওবামাকে শান্তির দূত অথবা সাম্রাজ্যবাদের খোলস পরিত্যাগকারী জনগণের পরিত্রাতা মনে করা রাজনৈতিক মূঢ়তা ও বালখিল্যতা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। (সুত্র, যুগান্তর, ০৭/০৬/২০০৯)
07 juin, 2009
Inscription à :
Publier les commentaires (Atom)
Aucun commentaire:
Enregistrer un commentaire