শহীদ জিয়ার শাহাদাতবার্ষিকীতে ড. মাহবুব উল্লাহ
আজ ৩০ মে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অষ্টবিংশতি-তম শাহাদাতবার্ষিকী। বছর ঘুরে এই দিনটি যখন আসে. আমরা এই মহান রাষ্ট্রনায়কের স্মৃতি তর্পণ করি; তার মাজারে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করি। সভা-সেমিনার করে তার সংক্ষিপ্ত অথচ বিশাল কর্মময় জীবন নিয়ে আলোচনা করি। দুস্হদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করি। কিন্তু এসব কিছুই তো আনুষ্ঠানিকতা। মহান নেতাদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে আনুষ্ঠানিকতা থাকাটাই স্বাভাবিক, বরং না থাকাটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতাই শেষ কথা নয়। এই দিনগুলো যে আত্মজিজ্ঞাসারও দিন, এই মহান মানুষটির আদর্শ-চিন্তা বুকে ধারণ করে সত্যিকার অর্থে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার দিন; সেই তাৎপর্য আমাদের চেতনায় প্রায়শই ভাস্বর হয়ে ওঠে না। আমরা কি কখনো ভেবেছি, জিয়াকে আমরা কতটুকু অনুসরণ করি? এই আত্মজিজ্ঞাসা না থাকলে শুধু পুষ্পার্ঘ কিংবা সুন্দর সুন্দর কথা বলে তার প্রতি আমাদের ঋণ কখনোই পরিশোধ হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে শহীদ জিয়ার উত্থান হয়েছিল উল্কার মতো। আমার হিসেবে জাতীয় রঙ্গমঞ্চে জিয়ার অবস্হান মাত্র এক দশক ছিল। পেশাগত জীবনে জিয়া রাজনীতিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সৈনিক। সৈনিকের জীবনে সর্বোচ্চ ব্রত হলো জীবন দিয়ে হলেও দেশের মর্যাদা রক্ষা করা। জিয়া সেই আদর্শ থেকে এক বিন্দুও বিচ্যুত হননি। একজন মহান মনীষী বলেছিলেন, �রাজনীতি হলো রক্তপাতহীন যুদ্ধ এবং যুদ্ধ হলো রক্তপাতময় রাজনীতি�। প্রকৃষ্ট বিচারে যুদ্ধের মধ্য দিয়েই রাজনীতি তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। যে মানুষটি কখনো ভাবননি যে, তিনি রাজনীতি করবেন; সেই মানুষটি �৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যখন প্রচন্ড হিংস্রতা নিয়ে এদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন শহীদ জিয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামান্যতম দ্বিধা ছিল না। তিনি তার সৈনিকদের উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন ডব ৎবাড়ষঃ. তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন সামরিক জান্তার নৃশংসতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে। এরপর কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিশেহারা জাতিকে পথচলার দিশা জুগিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পরম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে হয়েছিলেন �বীরউত্তম�। ইতিহাসের এক চরম ক্রান্তিলগ্নে তিনি ঐতিহাসিক ভুমিকা পালন করেছিলেন। সেদিন জিয়া যদি বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের ডাক না দিতেন, তাহলে আজকের বাংলাদেশ হতো কিনা সন্দেহ আছে। তিনি কোনো দলের লোক ছিলেন না। সামরিক বাহিনীর একজন সুশৃঙ্খল অফিসার হিসেবে তাঁর শপথ ছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির অখন্ডতা ও সংহতি রক্ষা করা। অথচ যখন দেখা গেল সেই রাষ্ট্র তার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিরাপত্তা রক্ষা করছে না বরং রক্তাক্ত গণহত্যার মধ্য দিয়ে সেই জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার পথ বেছে নিয়েছে, তখন শহীদ জিয়ার আনুগত্য থাকল জনগণের প্রতি। জনগণকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। সুতরাং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য শেষ বিচারে জনগণের প্রতি আনুগত্যেরই শামিল। অথচ এই জিয়া ১৯৬৫�র পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে বীরত্বের সঙ্গে আগ্রাসী ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ লড়াই করেছিলেন। সেটিও তাঁর জীবনের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। সেই সময় সমগ্র পাকিস্তানের জনগণ ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছিল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রেসিডেন্ট পদটি একজন সামরিক স্বৈরশাসকের হাতে থাকা সত্ত্বেও জনগণের দেশপ্রেম চেতনায় কোনো ঘাটতি ছিল না। তৎকালীন পুর্ববাংলার অবিসংবাদিত নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান উভয়ই ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিরোধ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, ১৯৭১-এ পাকিস্তানি শাসকদের হঠকারিতা ও মুঢ়তার জন্য পুর্ববাংলার জনগণকে �যার যা আছে� তা দিয়েই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্মমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে তারা বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিলেন। পুর্ববাংলায় অবস্হানরত বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের জওয়ানরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রধান ব্যুহে পরিণত হয়েছিল। সে কারণেই বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর জন্ম। এটি অৎসু ড়ভ খরনবৎধঃরড়হ. যেমন করে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্ম। খেমকারান সেক্টরে লড়াই করতে গিয়ে জিয়া একজন ভারতীয় সেনা অফিসারের কাছ থেকে একটি রিভলবার দখল করে নিয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক রিভলবারটি তিনি ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্টের পর যখন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন, তার কয়েকদিন পর একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেনা জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। সেই সময় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় জিয়া কতৃ�ক রিভলবার হস্তান্তরের দৃশ্যটি ছাপা হয়েছিল। একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক যতদিন বেঁচে থাকেন, তার কর্তব্য হলো যে কোনো আগ্রাসী শক্তিকে মোকাবিলা করা। জিয়া তার সমগ্র জীবনে এই কাজটি করেছিলেন। ভারতীয় সমরনায়কের কাছ থেকে দখল করা রিভলবারটি আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে জিয়া সমগ্র জাতিকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। বার্তাটি হলো দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্হিতিতে �৭১-এর বন্ধু রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সরল কথাটি আমাদের আত্মবিনাশী বুদ্ধিজীবী এবং অনেক রাজনীতিকই বুঝতে চান না। তারা বুঝতে চান না, কোনো জাতির চিরন্তন কোনো বন্ধু নেই। আছে শুধু চিরন্তন স্বার্থ। জাতীয় স্বার্থের আলোকেই রাষ্ট্রের বন্ধু-শত্রু নির্ধারিত হয়। ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ শহীদ জিয়া জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের কর্ণধার রুপে আবির্ভুত হন। এর আগে ঘটেছিল ১৫ আগষ্ট। ১৫ আগষ্টের ঘটনা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য। ১৭৯২ সালে ফরাসি দেশের মনীষীর এই উক্তিটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ফরাসি বিপ্লবের কথা। ১৭৮৯-এ যে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল সেই বিপ্লবের মুলমন্ত্র ছিল-�সাম্য�, �মৈত্রী� ও �স্বাধীনতা�। এই মহান মুল্যবোধগুলো অর্জন করতে গিয়ে ফরাসি জাতিকে অনেক রক্ত দিতে হয়েছিল। অত্যাচারীর রক্তে সিক্ত হয়েছিল ফরাসি দেশের মাটি। হয়তো প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি রক্ত ঝরেছিল। তবে সবচাইতে শ্রেয় পথ হলো, রক্ত না ঝরিয়ে মহান কিছু যদি অর্জন করা যায়। জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, অনেক রক্ত ঝরেছে। কিন্তু আমাদের অর্জন বেদনাদায়কভাবে অত্যন্ত সামান্য। জিয়া ক্ষমতা দখলকারী ছিলেন না। জনগণ তাকে ক্ষমতার আসনে বসিয়েছিল। রাষ্ট্রহীনতার ভয়াবহ বিপদ থেকে রাষ্ট্র উদ্ধার এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য সেদিন একমাত্র আশা-ভরসার স্হল হিসেবে জিয়াই ছিলেন সঠিক মানুষ। জাতীয় ঐক্য বলতে মত ও পথের ভিন্নতা না থাকা বোঝায় না। মত ও পথের ভিন্নতা একটি জাতির জন্য প্রাণপ্রাচুর্যের উৎস। মত ও পথের ভিন্নতা প্রকাশের সুযোগকে ব্যবহার করে জাতীয় লক্ষ্য নির্বাচন করতে পারাটাই জাতির প্রাণশক্তির বহিঃপ্রকাশ। শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত একদলীয় স্বৈরশাসনের জায়গায় বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করে শহীদ জিয়া জাতিকে অভীষ্ট অর্জনের পথে বিরাট একধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন। এদেশে এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা শহীদ জিয়াকে �ইতিহাসের খলনায়ক� হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে প্রচন্ড চিত্তসুখ অনুভব করে। সংবিধানের যে পঞ্চম সংশোধনী জাতিকে গণতন্ত্রের সিংহদ্বারে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছিল, আজ তারা সেই পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে জাতীয় পরিত্রাণের সম্ভাবনা দেখতে পান। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে জাতি হিসেবে আমাদের মৌল জাতীয় মুল্যবোধগুলো হারিয়ে যাবে। সংবিধানের সিংহচুড়ায় এমন কিছু মুল নীতি সংযোজিত হবে, যার অর্থ দাঁড়াবে ভারত ও বাংলাদেশ দুটি পৃথক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় মুলনীতিতে কোনো পার্থক্য নেই এবং এই পার্থক্যহীনতার মধ্য দিয়ে এক দেহে লীন হওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। জাতি গঠনে জিয়ার ভুমিকাটি ছিল অনবদ্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে বিভ্রান্তির ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছিল। জাতি বলতে আমরা সেই সত্তাকে বুঝি যে সত্তা নিজ থেকে স্বয়ংসম্পুর্ণ এবং অবিভাজ্য। সব বাঙালি মিলে একটি জাতি কেন গঠিত হলো না তা বোঝার জন্য আমাদেরকে ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতে হয়। ভারতে ব্রিটিশ শাসন অবসানের সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎ বসু সব বাঙালিকে নিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দু এলিটরা এর মধ্যে চিরকালের জন্য মুসলিম আধিপত্যের বিপদ দেখতে পায়। তাদের কাছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার চাইতে বৃহৎ ভারতের প্রাদেশিক সত্তাই শ্রেয় বলে বিবেচিত হয়। পদ্মাপাড়ের বাংলাভাষীরা মায়ের ভাষা বাংলার জন্য রক্ত দিল। কিন্তু ভাগীরথী তীরের বাঙালিরা হিন্দির আধিপত্য কবুল করে নিল। এ থেকে কি বোঝা যায় না চৈতন্যের দিক থেকে সব বাঙালি এক নয়। নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালি বটে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সত্তা এবং সে সত্তা থেকে উৎসারিত জাতীয় পরিচয়ের দিক থেকে আমরা বাংলাদেশী। কোনো নির্দিষ্ট ভুখন্ডে শতকরা একশ� জন মানুষ নৃপরিচয়ের দিক থেকে অভিন্ন হয় না। বাংলাদেশে রয়েছে অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। তাদের বাদ দিয়ে এবং রাষ্ট্রীয় মুল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে জাতি গঠন সম্ভব নয়। ১৯৭২-এ সংবিধান প্রণয়নের সময় চাকমা নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, �একজন চাকমা বাঙালি হতে পারে না, একজন বাঙালি চাকমা হতে পারে না। কিন্তু আমরা সবাই বাংলাদেশী।� শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তবাদের ধারণার জন্মদান করে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়কে সুনির্দিষ্ট করে গেছেন। শুধু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হয়ে দৈনন্দিন রাষ্ট্র পরিচালনাই একজন রাষ্ট্রনায়কের কাজ হতে পারে না। তার থাকতে হয় সুদুরপ্রসারী ভিশন। শহীদ জিয়া একটি সুদুরপ্রসারী ভিশন নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। প্রয়োজনে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণে কুণ্ঠাবোধ করেননি। এখানেই ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি গঠন এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ ছিল শহীদ জিয়ার রাষ্ট্র পরিচালনার মুল চাবিকাঠি। জাতীয় অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করার জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগের পথকেও অর্গলমুক্ত করে দিয়েছিলেন। তিনি ছুটে গিয়েছিলেন কৃষকের ঘরে ঘরে। বাংলাদেশের কোনো নেতা আজ অবধি তাঁর মতো গণসংযোগ করে মানুষের সৃজনীশক্তির উদ্বোধন ঘটানোর উদ্যোগ নেননি। খাদ্যশস্যের উৎপাদন দ্বিগুণ করা, মৎস্য চাস, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খামার করে কৃষি উৎপাদনের দিগন্ত প্রসার ছিল তাঁর ভাবনা। আজ বাংলাদেশে কৃষির যতটুকু বহুমুখীকরণ হয়েছে সেটা জিয়ার নিরলস উদ্যোগের ফলেই সম্ভব হয়েছে। কৃষকের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা প্রসারের জন্য তিনি একশ� কোটি টাকার কৃষিঋণ প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। বিদেশে জনশক্তি রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সাফল্যের সুচনা শহীদ জিয়াই করেছিলেন। বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের দিক থেকে বাংলাদেশ আজ যে সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার জন্য জিয়ার হাতিয়ার ছিল স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে হৃদ্যতাপুর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ফলে এই ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যের স্বীকৃতি আমরা দেখতে পাই ইরাক-ইরান যুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর মধ্যস্হতায়, �আল কুদস� কমিটিতে বাংলাদেশের সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং জাপানের মতো রাষ্ট্রকে পরাজিত করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এভাবেই জিয়া �তলাবিহীন ঝুড়ি� হিসেবে আখ্যা পাওয়া বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। উত্তর কোরিয়া সফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সেই রাষ্ট্রের কাছ থেকে সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান অর্জন করে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জিম্মি ঘটনায় ইরানের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব থেকে বিরত থেকে জিয়া প্রমাণ করেছিলেন, বাংলাদেশ পরাশক্তির অনুগত কোনো দেশ নয়। একটি ক্ষুদ্র ও দরিদ্র দেশও যে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বিশ্বসভায় সম্মান ও মর্যাদার আসন পেতে পারে-জিয়া সেই সত্যটিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতের রক্তচক্ষুর কাছে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারত যখন বাংলাদেশকে পানিতে মারার ষড়যন্ত্র করেছিল তখন দেশীয় জনমত গঠনে মওলানা ভাসানীর সহায়তা নিয়ে এবং সমস্যাটির সফল আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে জিয়া ভারতকে ৫ বছর মেয়াদি পানিচুক্তি করতে বাধ্য করেছিলেন। জিয়া বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্হার �র� কতৃ�ক অনুপ্রাণিত কতিপয় বাংলাদেশী বিপথগামীর চোরাগোপ্তা হামলাকেও কঠোরভাবে প্রতিরোধ করেন। জিয়ার স্বাধীনচেতা মনোভাব ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্হা �র�র মোটেও সহ্য হচ্ছিল না। সংস্হাটি তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতিক্রমে জিয়াকে হত্যা করার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ইন্দিরা গান্ধীর উত্তরসুরি মোরারজি দেশাই�র সময় এই প্রকল্প স্হগিত হয়ে যায়। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্হিরতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে দুর্বল রাখার প্রয়াস এই সংস্হাটি কখনোই পরিত্যাগ করেনি। জিয়ার শাসনামলের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের বিচার দাবি করে দেশব্যাপী এক অচলাবস্হার সৃষ্টি করা হয়। সামরিক বাহিনীতেও এই অস্হিরতার তরঙ্গ আঘাত হানে। জিয়া মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের প্রতি সুবিচার করছেন না মর্মে সুক্ষ্ম প্রচারণা চালানো হয়। এ রকমই এক অস্হির পরিস্হিতিতে ৩০ মে, ১৯৮১ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল বিপথগামী সেনা অফিসারের অভ্যুত্থানে জিয়া শাহাদাৎ বরণ করেন। সাচ্চা জাতীয়তাবাদী নেতারা দুনিয়ার দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রে নিহত হয়েছেন। দেশপ্রেমই জিয়ার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে শহীদ জিয়া বাংলাদেশকে যে অবস্হায় দাঁড় করিয়ে গেছেন, সেখান থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে আনার যে কোনো প্রচেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য। আজ বাংলাদেশের আকাশে শকুনের পাখার ঝাপ্টানি আমরা প্রত্যক্ষ করছি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র চলছে। জিয়ার আদর্শকে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে বুকে ধারণ করতে পারি তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই বাংলাদেশের ক্ষতি করতে পারবে না। লেখকঃ অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট ষ্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (সুত্র, আমার দেশ ৩০/০৫/২০০৯)
30 mai, 2009
Inscription à :
Publier les commentaires (Atom)
Aucun commentaire:
Enregistrer un commentaire