মাহমুদুর রহমান
দৃশ্যকল্প এক. ভারতের রাজধানী দিল্লির প্রধান বিচারপতির এজলাস লোকে-লোকারণ্য। দেশী-বিদেশী উকিল ও সাংবাদিকরা ভিড় করে আছেন সেখানে এক ঐতিহাসিক বিচারানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং সেই বিচার প্রক্রিয়ার ওপর খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। বিচারের বিষয়বস্তু পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহ সম্পর্কিত। শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে স্ত্রী-পুত্রসহ তামিল বিদ্রোহী নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিন দশকব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান ঘটেছে। স্মরণ করা যেতে পারে এই প্রভাকরণের তামিল বিদ্রোহী বাহিনীর মহিলা আত্মঘাতী রেজিমেন্টের সদস্যের বোমা হামলাতেই ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ১৯৯১ সালে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছিলেন। তারই বিধবা স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী এখন শুধু কংগ্রেসের নয়, ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। সোনিয়া গান্ধীর আশীর্বাদধন্য ড. মনমোহন সিং ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় দ্বিতীয়বারের মতো সমাসীন হয়ে জওয়াহেরলাল নেহরুর রেকর্ড স্পর্শ করেছেন। এমতাবস্থায় বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়ে কংগ্রেস সরকার তামিল বিদ্রোহের সাথে জড়িত ভারতীয় সহযোগীদের বিচার করার বিস্ময়কর উদ্যোগ নিয়েছে। আসামির কাঠগড়ায় ইন্ধিরা গান্ধীর শাসনকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান, সেদেশের গোয়েন্দা সংস্থা র (RAW)-এর তৎকালীন প্রধান, তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ডিএমকে দলের বর্ষীয়ান নেতা করুণানিধি ও অন্যরা। অভিযুক্তরা আশির দশকে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে তার সঙ্গীসাথীসহ ভারতে আশ্রয় এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারপর তিন দশক ধরে তামিল বিদ্রোহী বাহিনীকে অর্থসাহায্য এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহসহ সব রকম সহায়তা প্রদান করেছে ভারত এবং তামিলনাড়ুর ধারাবাহিক সরকারগুলো। ফলে শ্রীলঙ্কার লক্ষাধিক সাধারণ জনগণ নিহত হওয়ার পাশাপাশি দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে। আশির দশকে যেভাবে রাষ্ট্রটি যে গতিতে উন্নতি লাভ করছিল তাতে তামিল বিদ্রোহের ঘটনা না ঘটলে শ্রীলঙ্কা হয়তো এত দিনে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতো। দিল্লির এ মামলায় একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য ইন্দিরা গান্ধীরও মরণোত্তর বিচার করা হবে কি না� এ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনার পর ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার রাষ্ট্র গঠনে ইন্দিরার বিশাল অবদানের কথা স্মরণে রেখে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবশ্য পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী ও পৌত্র রাহুল গান্ধী। একজনের স্বামী এবং অপরজনের পিতা হত্যার বিচার করার নামে তো আর প্রয়াত এক জননন্দিত প্রধানমন্ত্রীকে হেয় করা যায় না। দৃশ্যকল্প দুই. কলকাতা হাইকোর্ট। অনেকটা দিল্লি সুপ্রিমকোর্টের অবস্থাই, তবে ভিড়ের চাপ বোধগম্যভাবেই এখানে দিল্লির তুলনায় কম। কলকাতায় অভিযুক্তরা প্রধানত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এবং গোয়েন্দা সংস্থা র (RAW)-এর উচ্চপদস্থ কাওবয়েরা (kao boy)। কাওবয়ের বিষয়টি সম্যকভাবে বোঝার জন্য অনিসন্ধিৎসু পাঠক ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা বি, রমনের র-এর কাওবয়েরা নামক গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন। তিনটি অভিযোগে আসামিরা কলকাতা হাইকোর্ট বিচারপতিদের সম্মুখে দণ্ডায়মান। প্রথম অভিযোগ, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী চাকমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদে উসকানি প্রদান, সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অস্ত্রশস্ত্র, টাকা-পয়সা সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী সংগঠিত করে দেশটির বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ পরিচালনা। এই যুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যায় সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। প্রায় দুই দশকব্যাপী এই অপকর্ম চালানোর পর ১৯৯৬ সালে ভারতবান্ধব সরকার ঢাকায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই কেবল দেশটিতে হত্যাযজ্ঞে ইতি টানা হয়। দুই নম্বর অভিযোগ অবশ্য একটি স্বল্পকালীন সময়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ সংক্রান্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন একদলীয় শাসক শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর সেই সময়ের টাঙ্গাইলের বাকশালী গভর্নর আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে ভারতে এনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং অর্থ সরবরাহ করা হয়। একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার চরম নিন্দনীয় সিদ্ধান্তটি স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে এলেও তাকে আগের মতোই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মামলার তৃতীয় অভিযোগটি অধিকতর মারাত্মক। ছয় বছর ধরে অবিরাম প্রচেষ্টার পর প্রতিবেশী দেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার অভিযোগ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার অব্যবহিত পরই গোয়েন্দা সংস্থা র কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সত্তর দশকের শেষার্ধে স্বল্পসময়ের জন্য মোরারজি দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে এ অশুভ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলেও পরবর্তী নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী জয় লাভ করার পর হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় আর বিলম্ব করা হয়নি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে মুক্তিযুদ্ধের মহান ঘোষক এই জাতীয়তাবাদী নেতাকে হত্যা করার ফলেই বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভারতীয় চর অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বর্তমান ভারত সরকার তাদের অতীত নোংরা কার্যক্রমের জন্য অতিশয় লজ্জিত হওয়ার কারণেই সব অপকর্মের হোতাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। এ দিকে কালিদাস বৈদ্য, চিত্তরঞ্জন সুতারসহ বঙ্গভূমিওয়ালাদের তাদের কাজকর্ম গুটিয়ে নিয়ে সাত দিনের মধ্যে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে তসলিমা নাসরিনকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তাকে আর কোনো দিনই ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে না। দৃশ্যকল্প তিন. ভারত যখন সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের জন্য সমগ্র বিশ্বে নন্দিত হচ্ছে, পাকিস্তানই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? রাজধানী ইসলামাবাদে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুজাহিদদের সাহায্য প্রদান প্রক্রিয়া এবং সিআইএ�র সহযোগিতায় তালেবান গোষ্ঠী তৈরির পেছনে যেসব সামরিক ও গোয়েন্দা (আইএসআই) কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন তাদের সবার বিচারের জন্যই এই বিশেষ ট্রাইবুনাল। বিমান দুর্ঘটনায় (?) নিহত সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হককে মরণোত্তর বিচারের উদ্যোগ নেয়া হলেও আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শেষ মুহূর্তে তাকে মরণোত্তর মার্জনা করা হয়েছে। এ দিকে ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশের কাছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করা তো হয়েছেই, সেই সাথে দেশটির মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকারকে বলে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমাপ্ত হওয়ামাত্র পাকিস্তানেও ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে যারা জীবিত রয়েছেন তাদের বিচার প্রক্রিয়াও আরম্ভ হয়ে যাবে। এখানে অবশ্য ছোট্ট একটা গোল বেধেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন দলটির নীতিনির্ধারকদের একটি বৃহৎ অংশ মনে করছে, ইস্যুটি জীবিত রাখলেই বোধ হয় আখেরে লাভ বেশি। নির্বাচন প্রচারকালীন সময় সহানুভূতিশীল সংবাদমাধ্যমে দিনরাত ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের গল্প শোনানো হলে যে ভোটের বাক্স ওজনদার হয়ে ওঠে তার প্রমাণ তো ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে হাতেনাতে দেখা গেছে। আর ঘটনাচক্রে যদি ভবিষ্যতে আবার জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি শক্তি ক্ষমতাসীন হয়েই যায় তাহলে ঘাদানিক এবং সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামকে এগিয়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানো যাবে। এখন বিচারের আয়োজন করে যদি যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ করা না যায় তাহলে এই মহামূল্যবান রাজনৈতিক পুঁজি চিরকালের মতো নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। তার ওপর মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর মতি-গতিও ঠাহর করা যাচ্ছে না। বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের অর্থের বেশির ভাগই যে সেই অঞ্চল থেকেই আসে এটাই বা সরকার উপেক্ষা করে কী করে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ সফরে রেকর্ড সৃষ্টিকারিণী আমাদের �চৌকস� পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি স্বয়ং ইসলামাবাদে উড়ে গিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সে দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে একটু ধৈর্য ধরার জন্য রীতিমতো আকুতি জানিয়ে এসেছেন। দৃশ্যকল্প চার. সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ এখন ওয়াশিংটনের দিকে। ক্যাপিটল হিলে দিনের পর দিন শুনানি চলছে। সে দেশের আইনে যেহেতু গোয়েন্দাদের শক্ত দায়মুক্তি দেয়া আছে, কাজেই সিনেট ও কংগ্রেসে জবাবদিহিতার জন্য তলব করা হয়েছে সাবেক জুতা�বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশসহ (জুনিয়র) তার দুই মেয়াদের সব রথী-মহারথীর। ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় কলিন পাওয়েল ও কন্ডলিজা রাইস, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড এবং ইরাকের সম্পদ লুণ্ঠনকারী মহাতস্কর ও জল্লাদ পল ব্রেমার কেউ বাদ পড়েননি অভিযুক্তের তালিকা থেকে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে বিভ্রান্ত করে দেশটিকে অনৈতিক ইরাক যুদ্ধে ঠেলে দিয়ে লাখ লাখ নিরপরাধ ইরাকিকে হত্যা করা তো হয়েছেই উপরন্তু হাজার হাজার মার্কিন সৈন্য হতাহত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতির ধ্বংসসাধন। ওয়াশিংটনের রাস্তায় হাজার হাজার মার্কিন নাগরিক বিক্ষোভ মিছিল থেকে দাবি তুলছে বুশ গংকে হয় গুয়ানতানামো বে অথবা ইরাকের আবুগারিব কারাগারে নির্বাসনে পাঠিয়ে তাদের সাথেও একই আচরণ করতে হবে, যে আচরণ তারা সেখানকার বন্দীদের সাথে বছরের পর বছর ধরে করেছে। পৃথিবীর সব দেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা তাদের মেজবান দেশের জনগণের কাছে অতীত কৃতকর্মের জন্য দলে দলে ক্ষমা ভিক্ষা করছেন। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করে এক-এগারোর �মহামানব�কে সমর্থন করার দায় মাথায় নিয়ে এ দেশের ১৫ কোটি নাগরিকের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। একই সংবাদ সম্মেলনে তারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধাচরণ এবং ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় বাংলাদেশে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ সরকারও ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর ক্ষমা করার মহান ঔদার্যের কথা জাতিকে পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন কুকর্ম ভুলে ক্ষমার ঐতিহ্য অব্যাহত রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কল্পনার রাজ্য থেকে এবার বাস্তবে নেমে আসি। ওপরের চারটি দৃশ্যের অনুরূপ কোনো ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব নিরাপত্তা কৌশল থাকে। ধারাবাহিক সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সেই কৌশল নিয়ে ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের কোনো সরকারই রাষ্ট্রের গোপনীয় নিরাপত্তা কৌশল দেশের স্বার্থে বাজারের আলোচনার বিষয়ে পরিণত করে না। স্বাধীনতার তথাকথিত ধারক-বাহকরা দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার তদন্তের নামে এই অতি গর্হিত কাজটি করে অজ্ঞানে অথবা সজ্ঞানে বাংলাদেশকে ভয়ঙ্কর নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন। সরকারের সেই অপকর্মের সাথে সোৎসাহে যুক্ত হয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং রাষ্ট্রবিরোধী সংবাদমাধ্যম। বাংলাদেশ সরকারের জ্ঞাতসারেই নাকি ভারতের আসাম রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী উলফাকে দশ ট্রাক অস্ত্র পাঠানো হচ্ছিল� এই যে কাহিনী সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী সংবাদমাধ্যমগুলোয় ছড়ানো হচ্ছে তার ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের প্রেক্ষাপট ক্রমশ তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের সুবিন্যস্ত কেশধারী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের হুঙ্কার শুনলে তো তাকে দিল্লির খাস প্রতিনিধি মনে করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একটি চিহ্নিত, অতি উৎসাহী পত্রিকা তো এ অস্ত্র সরবরাহ প্রক্রিয়ার সাথে অধুনা আলকায়েদার সংযোগও আবিষ্কার করেছেন। এক রামে রক্ষা নেই, তায় সুগ্রীব দোসর। অর্থাৎ কেবল ভারতীয় বাহিনী ডেকে আনলে চলবে না, একই সাথে বাংলাদেশকে মার্কিন ও ইসরাইলের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানোর পাঁয়তারাও চলছে। ১৭৫৭ সালে এই অঞ্চলের জনগণ নির্বিকার চিত্তে দেশের স্বাধীনতা সূর্য লর্ড ক্লাইভের অতি ক্ষুদ্র সাম্রাজ্যবাদী বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় কিছু দালালের হাতে ছিনতাই হতে দিয়েছিল। দীর্ঘ আড়াই শ� বছর পর বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্ভবত একই নাটকের পুনর্মঞ্চায়ন হতে চলেছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের মনমানসকে এমনভাবে রোগাক্রান্ত করে ফেলেছে যে ভারতের কাছে নতজানু সরকারের সব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড আমরা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিচ্ছি। গত পাঁচ মাসে চোখের সামনে নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট একটার পর একটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে। বিডিআর গেছে, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের দল বেঁধে কেবল হত্যাই করা হয়নি তারা এতটাই হীনবল যে কোথাকার এক সাবেক আমলা সমগ্র সেনাবাহিনীকে প্রকাশ্যে জঙ্গি আখ্যা দিলেও তার প্রতিবাদ করার জন্য একজন সেনাসদস্যকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। সবশেষে সরকার এখন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার মহৎ কর্মে লিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের আচরণ দেখে যেকোনো নাগরিকের মনে হতে পারে, এই সরকার প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় আনন্দবাজার পত্রিকার নির্দেশনায় পরিচালিত হচ্ছে। সাবেক ডিজিএনএসআই মেজর জেনারেল (অবঃ) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী সম্পর্কে ভারতীয় পত্রিকাটি এক-এগারোর পর থেকেই অনেক কল্পকাহিনী রচনা করেছে। সেসব কাহিনীর কোনো কোনোটিতে জেনারেল হায়দারের সাথে আবার তারেক রহমানকেও জড়িত করার চেষ্টা লক্ষ করা গেছে। বর্তমান সরকার এবং তাদের বশংবদ বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যম চরম সাম্প্রদায়িক আনন্দবাজারের কাহিনী এখন দেশবাসীকে গেলানোর প্রাণান্তকর চেষ্টায় রত। সর্বৈব মিথ্যা অথচ রসালো গল্প শোনার জন্য সর্বদা উদগ্রীব বাঙালিকে যে প্রচারণায় ভোলানো সহজ সে তো আমরা গত বছর ২৯ ডিসেম্বর প্রত্যক্ষ করেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ তো দূরের কথা, এ ভূখণ্ড তার স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে কি না, সেটাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা জাগছে, দিন বদল করার প্রয়াসে আবার না দেশের পতাকা বদল হয়ে যায়। আজকের কলাম পাঠ করে যেকোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকই যে বিমর্ষ হয়ে উঠবেন সেটি বুঝতে পারছি। শুরু করেছিলাম কাল্পনিক বিশ্বের বানানো গল্প দিয়ে। তারপর বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রত্যাবর্তন করেছি। এই আশা পোষণ করে লেখার শেষে খানিকটা হাস্যরসের অবতারণা করছি যে এক চিলতে মুচকি হাসি হয়তো পাঠকের বিষণ্নতা কিছুক্ষণের জন্য হলেও দূর করবে। গল্পটি দেশের সর্বত্র সরকারের বায়বীয় জঙ্গি খোঁজা নিয়েঃ এক ত্যাঁদড় ছাত্রকে শিক্ষক কুমিরের ওপর রচনা লিখতে দিয়েছেন। ছাত্র লিখল, কুমির সরীসৃপ প্রজাতির এক অতি হিংস্র, মাংসাশী প্রাণী। সে পানিতে বিচরণ করে। তার বিশাল শরীর, বিকট দর্শন এবং বিরাট লম্বা লেজ। লেজের মধ্যে খাঁজকাটা, খাঁজকাটা...। পরবর্তী পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে কেবলই �খাঁজ কাটা� কথাটি লেখা। রচনা পড়ে রাগান্বিত শিক্ষক ছাত্রের কাছে এই বাঁদরামির অর্থ জানতে চাইলেন। ছাত্র বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে জবাব দিলো� স্যার, কুমিরের লেজ অনেক লম্বা এবং সেই লেজে এত বেশি খাঁজ যে খাঁজকাটা লিখে শেষ করা যাচ্ছে না। শিক্ষক ব্যাপারটি বুঝলেন এবং ছাত্রকে পরদিন গরুবিষয়ক রচনা লিখে নিয়ে আসতে বললেন। ছাত্র পরদিন রচনা লিখলঃ আমাদের গরুটিকে গোসল করানোর জন্য গতকাল বাড়ির পাশের নদীতে নিয়ে গেছিলাম। গোসল করাচ্ছি, এমন সময় এক বিরাট কুমির এসে উপস্থিত। তার লম্বা লেজে কেবলই খাঁজকাটা, খাঁজকাটা...। রাগে অগ্নিশর্মা শিক্ষক ভাবলেন ছাত্রকে এমন বিষয়ের ওপর রচনা লিখতে দিতে হবে যার ত্রিসীমানায় কুমিরের অস্তিত্ব নেই। গম্ভীর হয়ে বললেন, আগামীকাল তোমাদের বাড়ির বিষয়ে রচনা লিখে নিয়ে আসবে। ছাত্র লিখে নিয়ে এলোঃ গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় আমাদের বাড়ি একেবারে তলিয়ে গেছিল। পরিবারের সবাই মিলে আমরা বাঁশের মাচার ওপর থাকতে লাগলাম। এক রাতে সেই মাচার নিচে ভয়ঙ্কর এক কুমির এসে উপস্থিত। আশা করি রচনার বাকি অংশ পাঠককে আর বলতে হবে না। আবার সেই খাঁজকাটার গল্প। অনেক চিন্তাভাবনা করে শিক্ষক এবার রচনার বিষয় নির্ধারণ করলেন পলাশীর যুদ্ধ। মনে মনে ভাবলেন, এবার দেখি ব্যাটা, পলাশীর প্রান্তরে কুমির কোথায় পাস? পরদিন ছাত্রের রচনা পাঠ করে স্কুলশিক্ষকের চাকরি ছেড়ে ভদ্রলোক এক কাপড়ে গ্রাম ত্যাগ করলেন। ছাত্র লিখেছিল মীরজাফর আলী খান নামক সেনাপতি নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর নিকটাত্মীয় হলেও অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ছিলেন। নিজের দেশ এবং নবাবের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আনুগত্য ছিল না । তা সত্ত্বেও শুধু আত্মীয়তার সুবাদে মীরজাফর আলী খানকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে নবাব প্রকৃতপক্ষে খাল কেটে কুমির নিয়ে এলেন। এরপর আগের মতোই খাঁজকাটা, খাঁজকাটা, খাঁজকাটা...। পাঠক, কষ্ট করে ছাত্রের স্থানে বর্তমান মহাজোট সরকার, শিক্ষকের জায়গায় বাংলাদেশের জনগণ এবং কুমিরের জায়গায় ইসলামি জঙ্গি বসিয়ে নিলে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সহজেই অনুধাবন করবেন। আর একটু মাথা খাটালে এক-এগারোর প্রেক্ষাপটে একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে সিরাজউদ্দৌলাহ ও মীরজাফরকেও চিনে ফেলা সম্ভব। লেখকঃ সাবেক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা এবং বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান mahmudurart@yahoo.com (সুত্র, নয়া দিগন্ত, ২৭/০৫/২০০৯)
26 mai, 2009
Inscription à :
Publier les commentaires (Atom)
Aucun commentaire:
Enregistrer un commentaire