ড. এম শমসের আলী
বাংলাদেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড� এম এ ওয়াজেদ মিয়া গত ৯ মে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে বিকেল ৪�২৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিলস্নাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। যতদিন বেঁচে আছি, আর কখনো তার সাথে দেখা হবে না, কথা হবে না। চিন্তা-চেতনাগুলো ভাগাভাগি হবে না। এমনটা ভাবতেই বিষাদে মন ভরে ওঠে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে, কোন কাজে মনোনিবেশ কঠিন হয়ে পড়েছে, দেহ-মন যেন নির্জীব হয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রতিটি মৃত্যু ঘটনা বড় কষ্টের, বড্ড যাতনার। খুব আপনজন, কিংবা খুব কাছের মানুষ হারানোর ব্যথা, ভাষায় প্রকাশ করা কিংবা লিখে জানানো এক কথায় অসম্ভব ব্যাপার। ড� এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে হারিয়ে আমি যেন আমার ছোট ভাই হারানোর ব্যথা অনুভব করছি। কতদিনের কত কত স্মৃতি, কত ছবি, কত ভাব বিনিময় কেবলি মনের মনিকোঠায় ভেসে উঠছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ১৯৫৬ সালে। ড� ওয়াজেদ ভর্তি হন ১৯৫৮ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র ধরেই তার সাথে আমার পরিচয় এবং সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। দু�জনের মধ্যে ছিল চমৎকার বোঝাপরা। তার জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের অনেক কিছু মিল লক্ষণীয়। যেমন আমরা দু�জনেই ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিলাম। দু�জনেই থাকতাম এফ এইচ হলে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর আমি তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে যোগ দিই, আমার কিছু পরে তিনিও সেখানে যোগদান করেন। এরপর আমি পিএইচডি ডিগ্রি নিতে ইংল্যান্ড চলে যাই, আমি যাবার কিছু পর তিনিও ইংল্যান্ডে চলে আসেন। উলেস্নখ্য, আমরা উভয়ে থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি। পরবর্তীতে আমি আণবিক শক্তি কমিশনের সভাপতি হই, আমার পর তিনিও সে একই পদ অলঙ্কৃত করেন। তিনি যেন অবচেতনে আমাকেই অনুসরণ করেছেন। তার আর আমার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মিল থাকলেও কিছু পার্থক্যও রয়েছে। যেমনঅৈামি কখনো রাজনীতির ধারে কাছে যাইনি, তিনি ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আমার বিয়ে কোন রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ের সাথে হয়নি, ড� ওয়াজেদ মিয়ার বিয়ে হয় বাংলাদেশের বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারের বড় মেয়ের সাথে। আমি জেনে খুশি হয়েছিলাম এই জন্য যে, বঙ্গবন্ধু ড� ওয়াজেদ মিয়াকে রাজনীতিতে আনতে চাননি। বিজ্ঞানী হিসেবেই তাকে দেখতে চেয়েছেন। রাজনীতিতে তাকে কখনোই জড়ানোর চেষ্টা করেননি। ড� ওয়াজেদ মিয়া�র জীবনকে দু�ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমতঃ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী তার ছাত্র ও ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া জীবন এবং দ্বিতীয়ত তার বিজ্ঞান গবেষণায় নিবেদিত জীবন। ১৯৬৯ সালে আমি তখন ইতালির ত্রিএ্যাস্ত শহরে। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স এ আমি অ্যাসোসিয়েট হই । ড� ওয়াজেদও অ্যাসোসিয়েট হন। ইতালিতেই আমি প্রথম শেখ হাসিনাকে দেখি। তখন সবেমাত্র তাদের বিয়ে হয়েছে। শেখ হাসিনাকে তখন দেখে আমার মনে হয়েছে নিরাভরণ, নিরহঙ্কার, সাদামাটা এক মেয়ে। গায়ের গড়ন খুবই হালকা-পাতলা। সে সময় আমি ও ওয়াজেদ মিয়া একই সঙ্গে কাটিয়েছি। সে সূত্রে তাদের বাসায় আমার যাওয়া পড়তো। এখানে শেখ হাসিনার অতিথিপরায়ণ মনের পরিচয় পাই, মাঝে মাঝেই তার আতিথেয়তা আমি গ্রহণ করি। ইতালির অনেক ছবি এখনো মনে ভেসে ওঠে। সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আবদুস সালামের কাছে আমি ও ওয়াজেদ প্রায়ই যেতাম। বিজ্ঞানী সালাম আমাদের দু�জনকেই খুব পছন্দ করতেন। সাউথ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে উন্নয়নশীল বিশ্বের ভাগ্য উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া অন্য কিছুই তিনি ভাবতে পারতেন না। আমরা দু�জনেই বিজ্ঞানী সালামের আদর্শে যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ হই। স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পর ওয়াজেদ রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত হবার পাশাপাশি আণবিক শক্তি কমিশন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সাভারে এ কমিশনের জমি গঠন থেকে শুরু করে এটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পুরো কৃতিত্বটা তাকেই দেয়া যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলে তিনি এতে প্রচণ্ড রকম মানসিক আঘাত পান। যা তার সৃজনশীল জীবন থেকে কয়েক বছর কেড়ে নেয়। জীবনের শেষ প্রায় বিশ বছর তিনি মানসিকভাবে আহত ছিলেন। শেখ হাসিনা তাকে কাছে থেকে যেভাবে সেবা শুশ্রূষা ও সাহচর্য দিয়েছেন, তা দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে। ওয়াজেদের চরিত্রের একটি বিশেষ দিক হলো তিনি সব কথা সরাসরি বলতেন। আমি তাকে কথা মনিটরিং করে বলতে বলতাম। মাঝে মাঝে বড় ভাইসুলভ হালকা বকুনিও তাকে দিয়েছি। তার ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। আমাদের ছেড়ে চলে যাবার এক সপ্তাহ আগেও তার সাথে দেখা করতে স্কয়ার হাসপাতালে গিয়েছি। তখন তার ডায়লেসিস চলছিল। কর্তব্যরত চিকিৎসক আমাকে চিনতেন বলে দেখা করতে দিলেন। আমাকে দেখে ওয়াজেদ ৫০ বছর আগের স্মৃতিতে ফিরে গেলেন। আমি তার কথার কোন উত্তর দিইনি। জানি, তা দিলে কথা কেবল বেড়েই যাবে। তার শেষ কথা ছিল, আপনি টিভিতে যেসব অনুষ্ঠান করেন, তা চালিয়ে যাচ্ছেন তো? আমি নীরব থেকে তার কষ্ট মুক্তির জন্য মনে মনে দোয়া করে চলে আসি। এ সময় তার ভাস্তে শামীম সেখানে উপস্থিত ছিল। ওয়াজেদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার অবকাঠামো নির্মাণে, বিজ্ঞান সাধনা ও কর্ম চাঞ্চল্যতার প্রতি আমার ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। আমরা দু�জনেই বিজ্ঞান নিয়ে সারাজীবন কাটিয়েছি। দেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে আমাদের দু�জনের মধ্যে হতাশা ছিল। বিশেষত আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তানে বিজ্ঞানে অনেক দূর অগ্রসর হলেও আমরা পারিনি। আমাদের এই স্বাধীন দেশে এতগুলো সরকার ক্ষমতায় এলেও তারা বিজ্ঞান ও গবেষণা নিয়ে বড় কোন পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্যোগী হয়নি। তাই হতাশায় বলতে হয়, দেশে আজ বিজ্ঞানের স্থান কোথায়? অথচ, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো বিজ্ঞান গবেষণায় ছোট-বড় অর্জন করেই চলেছে। অথচ, আমরা স্বাধীনতার ৩৮ বছরেও বিজ্ঞান গবেষণায় বিশেষ অর্জনে সক্ষম হইনি। আমাদের অর্থনীতিবিদরা এ নিয়ে মাথা ঘামান বলে মনে হয় না। কেবল আমদানি-রপ্তানি আয় করলেই একটি দেশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে না এর সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমাদের দেশে বিজ্ঞানীদের সুযোগ দিলে দেশ বিজ্ঞানে অর্থনীতিতে অনেক দূর এগিয়ে যাবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমাদের খনিতে যে গ্যাস, কয়লা রয়েছে, তা যদি আমরা উত্তোলনের চেষ্টা করতাম, তবে আমাদের ইমেজ অন্যরকম হতে পারতো। আমাদের দেশে বিজ্ঞানের কদর নেই, তাই বিজ্ঞানীদেরও কোন কদর নেই। পৃথিবীর অনেক দেশে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বিজ্ঞানের সাব কমিটি থাকলেও, আমাদের দেশে তা নেই। বিজ্ঞান নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন ওয়াজেদ। দেশে একটি বিজ্ঞান ভবন নির্মিত হবে। এ নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। ডিজাইন করা হলো, জায়গা ঠিক করা হলো, কিন্তু কেন যেন ভবন নির্মাণ হলো না। তার আরো স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞানীদের একটি অ্যাপেক্স বডি তত্ত্বাবধান করবে। বিজ্ঞান ভবনে বসে বিজ্ঞানীরা দেশের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ করবে। এখানে বৈজ্ঞানিক সম্মেলন হবে। ড� ওয়াজেদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে সেজন্য সরকারের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি। ওয়াজেদ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবে তার কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে। সেই কথাগুলো যদি বর্তমান সরকার কানে নেন, তবে একটি কাজের কাজ হয়। প্রধানমন্ত্রী এখন স্বামী হারাবার শোকে ব্যথিত, তাকে শান্ত�না দেবার ভাষা আমার নেই। গত ৪০ বছরের তাদের বিবাহিত জীবনে ড� ওয়াজেদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি তার পাশে থেকে যে ধৈর্য, সাহস ও সেবার পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন, তা অসাধারণ ও অসামান্য। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন, আপনিতো বিভিন্ন দেশে থেকে বিজ্ঞানের আয়োজন ও কার্যক্রম দেখেছেন, বিজ্ঞানের প্রয়োগ ছাড়া কি আমরা দিন বদল করতে পারবো, কিংবা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পারবো? এ কথা মাথায় রেখে যদি দেশের বিজ্ঞানীদের দেশ গড়ার কাজে আপনার পাশে রাখেন, আপনাকে শুধু এটুকু আশ্বাস দিতে পারি এ ব্যাপারে আপনি নিঃসঙ্গ থাকবেন না। এম এ ওয়াজেদ মিয়া সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের এক সন্তান হয়েও যিনি তার মেধা, প্রজ্ঞা ও অধ্যবসায়ের জোরে এতদূর পথ অতিক্রম করে হয়ে ওঠেন দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী। তার মৃত্যুতে দেশ একজন বিজ্ঞানীকেই হারালো না, হারালো একজন একনিষ্ঠ ও নিখাঁদ দেশ প্রেমিককে। তার প্রতি রইলো আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা, আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি, আর প্রধানমন্ত্রী এবং তার পরিবারের প্রতি রইলো আমার আন্ত�রিক সমবেদনা। লেখকঃ বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, ভিসি, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি
26 mai, 2009
Inscription à :
Publier les commentaires (Atom)
Aucun commentaire:
Enregistrer un commentaire