08 mai, 2009
রতনে রতন চেনে -মাহমুদুর রহমান
সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সম্প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদকে চারিত্রিক গুণাবলির মানদণ্ডে তার দলীয় সভানেত্রীর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। মন্ত্রীর বিবেচনায় সেনাপ্রধান এমন একজন মহামানব যিনি চরিত্রগুণে আব্রাহাম লিঙ্কন এবং জর্জ ওয়াশিংটনের সমতুল্য! ড. রাজ্জাক দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন। কিন্তু আমার অন্তত স্মরণে পড়ছে না আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে এই কৃষিবিদ রাজনীতিক কখনো এমন উচ্চ মার্গের স্তুতিবাক্য উচ্চারণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সৌদি আরব সফরকালীন তার দলের কর্মহীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের সম্পর্কে এক বোমা ফাটানো তথ্য দেশবাসীকে জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, এই মন্ত্রিসভার অনেকেই নাকি ডিজিএফআই�র বেতনভোগী চর, যা তার ভাষায় �পেইড এজেন্ট�। ড. আবদুর রাজ্জাকের প্রকাশ্য সেনাপ্রধান তোষণের সাথে আবদুল জলিলের মন্তব্যের যোগসূত্র আছে কি না, সেটি নির্ণয় করার দায়িত্ব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর। তবে মন্ত্রিসভা এবং দলের জন্য চরম বিব্রতকর বিবৃতি প্রদানের অপরাধে শেখ হাসিনা যে দলের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি সে তো দেশবাসী দেখতেই পাচ্ছে। উপরন্তু মে দিবসের এক অনুষ্ঠানে দলীয় সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদককে পাশাপাশি বসে আলাপচারিতায় মগ্ন দেখা গেছে। আমাদের সেনাপ্রধান যে বহু গুণে গুণান্বিত এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। জেনারেল সাহেব অবশ্যই মহামানব, কারণ তার নিজের দাবি অনুযায়ী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ তাকে স্বপ্নে দর্শন দেন। তিনি এমন একজন অসীম সাহসী সেনাপ্রধান যিনি জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তার নির্দেশে অনায়াসে দেশের সংবিধানকে তুচ্ছ বিবেচনা করে অস্ত্র দেখিয়ে রাষ্ট্রপতিকে যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে ব্যবহার করতে পারেন। দেশের দুই শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বায়বীয় সব অভিযোগে অসৌজন্যমূলকভাবে কারাগারে শুধু যে নিক্ষেপ করেন তাই নয়, তার ভয়ে দেশের কোথাও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রতিবাদ করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। যে সুশীল (?) সমাজ সারাজীবন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য খ্যাত তারাই জেনারেল মইনরূপী পরশপাথরের স্পর্শে রাতারাতি সেনাপ্রেমী হয়ে ওঠেন। টিআইবি প্রধান থেকে ডাকসাইটে সুশীল (?) পত্রিকা সম্পাদক পর্যন্ত বিশেষ সংস্থা থেকে ডাক পাওয়া মাত্র মুক্তকচ্ছ হয়ে ঢাকা সেনানিবাসে ছুটে যান রাজদর্শন ও বচনামৃত শ্রবণ করার অভিলাষে। সেই ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণের পর থেকে দীর্ঘ ৫৬ বছরে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ জমানায় সেনাপ্রধান তো আর কম দেখা হলো না। কিন্তু দেশের তাবৎ ব্যবসায়ী নেতারা হাতে লাউ, কুমড়াজাতীয় সবজি এবং অন্যান্য উপহারসামগ্রী নিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাপ্রধানের অতুলনীয় অবদানের জন্য অবনত মস্তকে তাকে সংবর্ধনা জানান� এমন অভাবনীয় দৃশ্য তো কখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সর্বোপরি বাংলাদেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা (নাউজুবিল্লাহ্) আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব যাকে ব্যক্তিগত বন্ধুরূপে বর্ণনা করেন তিনি ছাড়া অন্য কেউ এ দেশে মহামানবত্বের দাবিদার হতেই পারেন না। আমাদের খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য উল্লিখিত সব কারণে জেনারেল মইনকে আব্রাহাম লিঙ্কনের সাথে তুলনা করেননি। তার প্রশংসার একমাত্র হেতু হচ্ছে সেনাপ্রধান এমন একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন যার ফলে আওয়ামী লীগ ২৯ ডিসেম্বর এক অবিশ্বাস্য বিজয় অর্জন করে আবার একদলীয় বাকশাল রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রণয়নের স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছে। এবার কিন্তু প্রকৃতই অবাক হওয়ার পালা। এত দিন তো জানতাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। কাজেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনে বিজয় অর্জনে সহায়তা করাই যদি মহামানবের একমাত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে তাহলে তো সেই বিশেষণ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদার প্রাপ্য। এই ভদ্রলোক প্রায় দুই বছর ধরে কত চেষ্টাচরিত্র করে বিএনপিকে বিভক্ত করলেন। তার পছন্দের দল আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জয়লাভ করানোর জন্য হেন কৌশল নেই যা তিনি প্রয়োগ করেননি। এত সেবাদানের পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব কৃতিত্ব সেনাপ্রধানকে দেয়াটা বেইনসাফি হয়ে যাচ্ছে না? একেই বোধ হয় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। গত বছর ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনের আড়ালে যে দেশী�বিদেশী কুশীলবদের সহযোগিতায় প্রকৃতপক্ষে একটি প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার প্রমাণিত হলো। এর আগে অবশ্য মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টির প্রধান জেনারেল (অবঃ) এরশাদ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এক-এগারো না হলে আওয়ামী লীগ জীবনেও ক্ষমতায় আসতে পারত না এবং সেই কারণে তাদের সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এরপর দুই আর দুইয়ে চার মেলাতে দেশবাসীর আর সমস্যা হওয়ার কথা নয়। খাদ্যমন্ত্রীর কাছে একটি প্রশ্ন রেখে প্রসঙ্গান্তরে যাবো। আপনার বিবেচনায় জেনারেল মইন যদি আব্রাহাম লিঙ্কনের সমকক্ষ হন তাহলে তাবৎ আওয়ামী লীগ সমর্থকের কাছে নমস্য মহাপুরুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার কন্যার অবস্থানটা আর কত উচ্চে হবে বাংলাদেশের জনগণকে কৃপা করে জানাবেন কি? ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য �দেশরত্ন� শেখ হাসিনা এবার মহামূল্যবান রত্নরাজিতে সমৃদ্ধ এক নবীন মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। মাত্র চার মাসের মধ্যেই মন্ত্রীকুল তাদের দায়িত্ব পালনে এতই দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন যে কাকে বাদ দিয়ে কার প্রশংসা করি। বাণিজ্যরত্ন কর্নেল ফারুক (অবঃ) খান বিডিআর হত্যাযজ্ঞের তদন্তকাজে সমন্বয়কারীর ভূমিকায় কী অপরিসীম দক্ষতার প্রমাণই না দিয়ে চলেছেন! তার বুদ্ধিমত্তা এবং প্রকৃত তথ্য উদঘাটনে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার কাছে সরকারের তিন তিনটি তদন্ত দল হার মেনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে। চরম নিন্দনীয় এ ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি নিজস্ব গুপ্তচরের মাধ্যমে জেনেছেন ইসলামি জঙ্গিরাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বিদ্রোহের সাথে জড়িত জঙ্গিদের নাম-ঠিকানা অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী এখনো প্রকাশ করেননি। আমার ধারণা সরকারিভাবে যাবতীয় তদন্ত সমাপ্ত হওয়ার পরই কেবল কর্নেল (অবঃ) ফারুক খান আসল কাহিনী প্রকাশ করে দেশবাসীকে চমকিত করে দেবেন। এই চার মাসে রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা এতই ব্যস্ত যে, তার নিজের মন্ত্রণালয়ের কাজটি এখনো ঠিকমতো গুছিয়ে আনতে পারেননি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিচালনা করা অবশ্য তার মেধার তুলনায় অতি ক্ষুদ্র দায়িত্ব। মন্ত্রী মহোদয় অন্যান্য দায়িত্ব পালন থেকে একটু ফুরসত পেলেই দেখা যাবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কেমন তর তর করে এগিয়ে যায়। দেশের জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয়া আবশ্যক যে, এ মুহূর্তে তিনি দেশের সব স্বাধীনতাবিরোধীদের পরপারে পাঠিয়ে দিয়ে তার নেত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। আমাদের পানিমন্ত্রী টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে কী চমৎকার করেই না বললেন, ভারত আগে বাঁধ নির্মাণ সমাপ্ত করুক, তারপর না হয় বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যাবে। �নবীন� পানিমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দেয়া নিরর্থক হবে কি না জানি না, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ফারাক্কা বাঁধ শুধুই পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছিল। কথা ছিল, আমাদের পদ্মা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব যৌথভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেই ফারাক্কা বাঁধ স্থায়ীভাবে চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। ভারত তার কথা রাখেনি। পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া ফারাক্কা বাঁধ আর কোনো দিনই বন্ধ করা যায়নি এবং নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্য বাঁধটি যে মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে সেই তথ্য আশা করি একমাত্র আমাদের পানিমন্ত্রী ছাড়া এ দেশের প্রতিটি নাগরিকই জানেন। পানিসম্পদ নিয়ে তার আরো দুটো বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। শুকনো মৌসুমে ভারত বাংলাদেশের দিকে গঙ্গার পানিপ্রবাহ কমিয়ে দিলে বাংলাদেশের পানিমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারত যতটুকু পানি দয়া করে দিচ্ছে তাতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তি সম্পর্কে তার অপর জ্ঞানগর্ভ উক্তি হলো, বড় দেশের সাথে ঝগড়া করে তো আর পারা যাবে না। তাদের তোয়াজ করে বাংলাদেশ তার স্বার্থ যতটুকু আদায় করতে পারে তাতেই মঙ্গল। এ সবই অত্যন্ত মূল্যবান কথা সন্দেহ নেই। শুধু বুঝতে পারছি না বর্তমান পানিসম্পদ মন্ত্রী বাবু রমেশ চন্দ্র সেনের মতো নতজানু রাজনীতিবিদও যদি ভারতকে পর্যাপ্ত তোয়াজ করে প্রয়োজনীয় পানি আনতে না পারেন তাহলে আর কার পক্ষে এই অতীব কঠিন কাজটি সমাধা করা সম্ভব হবে? প্রতিবেশীর স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিশীল এমন পানিমন্ত্রী খুঁজে বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সব দেশবাসীর কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানানো একান্ত কর্তব্য। অবশ্য ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক আমার মন্তব্যের সাথে একমত হবেন কি না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী দু-একটি সেমিনারে সাবেক এই পানিমন্ত্রীর সম্প্রতি বাংলাদেশের সপক্ষে অবস্থান নেয়াটাকে আমি কেবল অপ্রাপ্তির হতাশাজনিত প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে তার দেশপ্রেমকে খাটো করতে চাচ্ছি না। তরুণ স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বিডিআর বিদ্রোহের �শান্তিপূর্ণ� সমাধান করে সামরিক বিদ্রোহ দমনে তার ব্যুৎপত্তির স্বাক্ষর রেখেছেন। অবশ্য বিভিন্ন পর্যায়ের ৬৩ জন সামরিক কর্মকর্তা ও ৬ জন বিডিআর সৈনিক নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তাকে চরমভাবে দুর্বল করে দেয়া দুর্ভাগ্যজনক বিদ্রোহটিকে শান্তিপূর্ণ আখ্যা দিতে সরকারের অন্ধ সমর্থক ছাড়া আর কতজন সম্মত হবেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সিআইডি�র তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিডিআর সৈনিকদের অসন্তোষের বিষয়ে বেশ কিছু দিন ধরে অবহিত ছিলেন। এমনকি গত ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের দু�দিন আগে বিদ্রোহী বিডিআর সৈনিকরা একসাথে বসে যে নৌকা মার্কাকে জেতানোর এবং আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসের মাধ্যমে তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি সংসদে পেশ করার সিদ্ধান্ত নেয় তাও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এত কিছু জানা সত্ত্বেও রক্তাক্ত বিদ্রোহে নেতৃত্ব দানকারী ১৪ জনকে সাথে নিয়ে কোন্ বিবেচনায় নানক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গেছেন এবং সরকার প্রধানের সাথে আপসরফার বৈঠক করেছেন তা তিনি ও তার নেত্রীই ভালো জানেন। আলোচিত ১৪ জনের একজন ডিএডি তৌহিদকে সরকার কিছু সময়ের জন্য বিডিআর প্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এখন বেকায়দায় পরে বেমালুম অস্বীকার করছে। তারুণ্যনির্ভর মন্ত্রিসভার এজাতীয় বালখিল্য কার্যকলাপ মেনে নেয়া ছাড়া দেশবাসীর গত্যন্তর নেই। বিডিআর�র অভ্যন্তরে যখন নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চলছিল সেই মুহূর্তে খাদ্যমন্ত্রী বর্ণিত মহামানব সেনাপ্রধান ঠিক কী দায়িত্ব পালন করছিলেন তা আজ পর্যন্ত রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। সহকর্মীদের কাছ থেকে এসওএস পাওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রাণ রক্ষার জন্য নূ�নতম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এমন তথ্য-প্রমাণ কোথাও মেলেনি। জেনারেল মইনের পক্ষ নিয়ে অনেকেই যুক্তি খাড়া করতে পারেন� বেসামরিক প্রশাসনের কাছ থেকে নির্দেশ না পাওয়ার জন্যই সংবিধানের প্রতি অনুগত সেনাপ্রধানের পক্ষে কোনো সেনা অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। এক-এগারোতে অবশ্য সংবিধানকে অনায়াসে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে জেনারেল মইনের কোনো সমস্যা হয়নি। তার পরও আমি ব্যক্তিগতভাবে সংবিধানের প্রতি সর্বদা সম্মান প্রদর্শনের পক্ষের লোক। সুতরাং সে দিক দিয়ে বিবেচনা করলে সরকারপ্রধানের নির্দেশ ছাড়া বিডিআরে সেনা অভিযান পরিচালনা না করে সেনাপ্রধান সঠিক কাজই করেছেন। তবে এ প্রসঙ্গে দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অবঃ) মইনুল হোসেন চৌধুরীর মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি টেলিভিশনের এক টকশোতে সেনা আইন উদ্ধৃত করে বলেছেন, সেনাবাহিনীতে কোথাও কোনো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটলে সেটি দমনের জন্য সাংবিধানিক সরকারের অনুমতির কোনো প্রয়োজন পড়ে না। বরং এসব ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেনা আইন সম্পর্কে যেহেতু আমার কোনো ধারণা নেই কাজেই এই বিতর্কে না জড়ানোই উত্তম। তরুণ ও চৌকস স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সরকারের ১০০ দিনের মধ্যেই জনগণের বিশেষ নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তার কেশ পরিচর্যা, বাচনভঙ্গি ইত্যাদির মধ্যে চারদলীয় জোট সরকারের বহুল আলোচিত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ছায়া অনেকে দেখতে পাচ্ছেন। তবে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম তাজউদ্দীন আহমেদের পুত্র সোহেল তাজ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে সুযোগ পেলেই দেশবাসীকে ভালোই ধমক-ধামক দিচ্ছেন। বিএনপি�র নেতাকর্মীদের শাসিয়ে বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাসস্থান নিয়ে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করলে তিনি তা কঠোর হস্তে দমন করবেন। এটা না হয় দলীয় রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার গেল। কিন্তু তিনি যে হুঙ্কারটির মধ্য দিয়ে তার ফ্যাসিবাদী চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা হলো পানি, বিদ্যুৎ নিয়ে জনগণ অসন্তোষ প্রকাশ কিংবা প্রতিবাদ করলে তাদের বিরুদ্ধে নাকি পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেই বিক্ষোভ প্রশমিত করা হবে। এই হলো জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের একজন নবীন প্রতিমন্ত্রীর মানসিকতা। এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকেই বিগত ড. ফখরুদ্দীন-জেনারেল মইন উদ্দিন যৌথ সরকারের জামানায় জিয়া বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আটকে দিয়ে বিদেশযাত্রা রোধ করা হলে সরকারের সেই অসৌজন্যমূলক আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করে তৎকালীন সাবেক সংসদ সদস্য সোহেল তাজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের কাছে পত্র পাঠিয়েছিলেন। জবাবদিহিতাবিহীন ক্ষমতা তার আচরণকে যে একেবারেই পাল্টে দিয়েছে তা দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ক�দিন আগে এক টকশোতে তিনি অভিযোগ করছিলেন, চারদলীয় জোট সরকারের আমলের পুলিশ তার সর্বাঙ্গে নাকি লাঠিপেটা করেছিল। এখন একই ব্যক্তি পানি-বিদ্যুৎ চাওয়ার অপরাধে সাধারণ জনগণকে লাঠিপেটা করার ভয় দেখাচ্ছেন। জন্মতারিখ হিসাব করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে নবীন বলা সম্ভব না হলেও মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতায় তিনিও নবীন। নির্বাচনে বিজয় লাভ করেই সরকারি ছাত্রসংগঠন যত্রতত্র দখলের রাজত্ব কায়েম করলে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন সন্ত্রাসের জন্য বিরোধী ছাত্রসংগঠনের ওপর দোষ চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যথেষ্ট সমালোচিত হয়ে সম্ভবত ওপরের নির্দেশে অনেক দিন নীরবতা পালন করেছেন। সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসস্থান ইস্যুতে আবার সরব হয়ে পেশিশক্তির ভীতি প্রদর্শনে তারই প্রতিমন্ত্রীর সাথে প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রত হয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই মন্ত্রীর ক্ষমতার লড়াই এত দুর্ভোগের মধ্যেও নাগরিকদের খানিকটা চিত্তবিনোদনের উপাদান দিচ্ছে। আইন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই আলোচিত মন্ত্রীর কর্মতৎপরতা বর্ণনা করে আজকের কলামের সমাপ্তি টানব। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কেবল যে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো ইসলামি জঙ্গিদের প্রজননক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছেন তাই নয়, মসজিদের ইমাম সাহেবরা তাদের ধর্মীয় বয়ানে মুসল্লিদের প্রায়ই বেহেশতে যাওয়ার কথা বলায় বিষম বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। আইনমন্ত্রী মহোদয়ের ধর্ম বিশ্বাস আমার জানা নেই। এ দেশের একাধিক বিখ্যাত ব্যক্তিকে আমি চিনি, যাদের নাম শুনে মুসলমান ধর্মাবলম্বী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা আপাদমস্তক নাস্তিক। ব্যারিস্টার শফিক এই গোষ্ঠীর একজন হতেও পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি বেহেশত-দোজখে বিশ্বাস না রাখলে আমজনতার কিছু যায়-আসে না। কিন্তু আমি এমন কোনো ধর্মগ্রন্থ এখনো খুঁজে পাইনি যেখানে বিশ্বাসীদের সৎ কর্মসম্পাদনের মাধ্যমে বেহেশতে যাওয়ার চেষ্টা করতে অনুপ্রাণিত করা হয়নি। মসজিদে খুতবা প্রদানের সময় ইমাম সাহেবরা যখন বেহেশত যাওয়ার কথা বলেন তখন কোনো মুসল্লিকে অসৎ কর্ম করতে বলেছেন এমন কোনো তথ্য আমার অন্তত জানা নেই। তাহলে তাদের অপরাধ কোনখানে, যা জনাব শফিক আহমেদকে এতটা ক্ষুব্ধ করে তুলেছে? অবশ্য বেহেশত শব্দের পরিবর্তে আইনমন্ত্রীর কাছে স্বর্গ কিংবা হেভেন (Heaven) শব্দ যদি অধিকতর পবিত্র মনে হয়ে থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। ক�দিন আগে এক সরকারি অনুষ্ঠান বাংলাদেশের রেওয়াজ অনুযায়ী কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে আরম্ভ হলে জনাব শফিক আহমেদের সহকর্মী বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মহাবিরক্ত হয়ে তেলাওয়াত বন্ধ করার নির্দেশ দেন বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। ইসলাম ধর্মে এলার্জি আওয়ামী লীগের সব সরকারেরই যে একটি অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তা বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা সমবেতভাবে আবারো প্রমাণ করলেন। বাংলাদেশ সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েই দিয়েছেন, আমাদের সংবিধান থেকে �বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম� এবং � সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস� অংশদ্বয় মুছে ফেলা হবে। সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গল্প। ডা. দিপু মনি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন যে সফররত মন্ত্রীর সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের বাফার স্টেট (Buffer State) হিসেবে কবুল করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি স্বাধীন দেশের ১৫ কোটি নাগরিকের মাথা হেঁট করে দিয়েছেন। তার সহকর্মী স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম অবশ্য মনে করেন, ডা. দিপু মনি বাফার স্টেট কথাটির অর্থই জানেন না। একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী �বাফার স্টেট� শব্দের অর্থ বোঝবেন না� তার মেধা সম্পর্কে এমন নিু ধারণা আমি এখনো পোষণ করতে চাচ্ছি না। তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে ওমরাহ পালন শেষে ঢাকায় ফিরে ডা. দিপু মনি সাংবাদিকদের কাছে সৌদি বাদশাহর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে যে সর্বৈব মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তারপর তাকে হয় অজ্ঞ নয়তো অসত্যভাষিণী বলা ছাড়া উপায় দেখছি না। গত সাত বছরে একমাত্র শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সৌদি বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ পেয়েছেন� এমন ডাহা মিথ্যা ভাষণের পরও ডা. দিপু মনি দুঃখ প্রকাশ করা অথবা ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজন অনুভব না করায় তার রুচি, শিক্ষা ও সংস্কার সম্পর্কে দেশবাসী সম্যক ধারণা করতে পেরেছেন। আসলে মহাজোট সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মাত্র চার মাসেই যে কীর্তিকলাপ আমাদের উপহার দিয়েছেন তা দিয়ে এখনই মহাভারতের মতো ঢাউস একখানা গ্রন্থ লিখে ফেলা সম্ভব। মোগল সম্রাট আকবর অনেক কীর্তির জন্যই পাক-ভারত উপমহাদেশে অমর হয়ে আছেন। তবে ঐতিহাসিকরা এই মহান মোগল সম্্রাটের সাফল্যের পেছনে তার রাজদরবার আলো করে থাকা ইতিহাসখ্যাত নবরত্নকে যথেষ্ট অধিক মূল্য দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলীয় বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী দ্বারা ইতোমধ্যে যেহেতু �দেশরত্ন� উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন কাজেই দিন বদলের পালায় এবার মন্ত্রিসভাকে মণিমুক্তা দিয়ে সমৃদ্ধ করতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। গত জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে পাঠক সেখানে মহাজোট মন্ত্রিসভার নবীন মন্ত্রীদের আগাম প্রশংসার ফুলঝুরি দেখতে পাবেন। সরকারের চার মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর মনে হচ্ছে দেশরত্ন আমাদের একদল মন্ত্রী নয়, আওয়ামী বলয়ের জ্যোতির্ময় রত্নসম্ভার উপহার দিয়েছেন। এই মহৎ কর্মের জন্য মহামতি সম্রাট আকবরের মতো তার নামও হয়তো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। অস্থিরচিত্ত বাঙালি সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইবে কি না সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন। লেখকঃ সাবেক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা এবং বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান mahmudurart@yahoo.com (সুত্র, নয়া দিগন্ত, ০৬/০৫/২০০৯)
Inscription à :
Publier les commentaires (Atom)
Aucun commentaire:
Enregistrer un commentaire