04 mai, 2009

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে সরকার কি পিছু হঠছে?

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে সরকার কি পিছু হঠছে?
ড. হোসেন খিলজী

বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে হঠাত করেই কেন জানি একটা ছন্দপতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত ২৮ এপ্রিল আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে আরো কিছুটা বিলম্ব হবে। ট্রাইব্যুনাল গঠন, প্রসিকিউটর নিয়োগ, ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি নিয়োগ ইত্যাদি কাজ এ বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশা করেন। এর আগে তিনিই বলেছিলেন, আগামী ডিসেম্বর মাসের আগেই এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আইনমন্ত্রী বলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় যাতে ভুল-ভ্রান্তি না হয়, বিচারটি যাতে আন্তর্জাতিক মানের হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, সেই বিষয়গুলো সরকার নিশ্চিত করতে চায়। তাড়াহুড়া করলে বিচারে ভুল-ভ্রান্তি হবে বলে তিনি মনে করেন (সমকাল, নয়া দিগন্ত, প্রথম আলো, ২৯.০৪.২০০৯)। অপর দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, যুদ্ধাপরাধিদের বিচার কবে হবে তা বলা মুশকিল (আমার দেশ, ২৭.০৪.২০০৯)। ২ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আবারও বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ যতটা সহজ মনে করা হয়, ততটা সহজ নয় (আরটিএনএন ০২.০৫.২০০৯)। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই সরকার বলছেন, তাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজটি দ্রত শুরু করতে চান। আবার কখনও কখনও আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সহ সরকারের অনেক মন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজটি অনেক কঠিন, জটিল। সহজসাধ্য নয়। সরকারের সাম্প্রতিক কথা বার্তা, বক্তব্যে মনে হচ্ছে তারা বিষয়টি নিয়ে আরও হোম ওয়ার্ক করতে চান বা এটা থেকে সরে আসতে চান।

১. অনেকে বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত ১৯৭৩ সালের আইনটির বেশ কিছু অসংগতি সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই আইনের অধীনে যে বিচার হবে সেটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। সরকার এই আইনে যথেষ্ট ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং এর দ্বারা মানবাধিকার রক্ষা হবে কি না তা নিয়ে ভাবতে চান আরও। অপর দিকে বিশেষজ্ঞরা এই আইনের বেশ কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরতে চান এভাবে,

ক. জানা যায়, ১৯৭২ এর সংবিধানে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কোনো বিধান সংযোজন করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমলে সরকার �৭২ ও �৭৩ এই দুটি বছর যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য প্রচুর সময় ব্যয় করেছে। ১৯৭৩ সালে আইন প্রণয়ন করেছে। এ জন্য সংবিধান প্রণয়নের ৬ মাস পর সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত আইনটি ১৯৭৩ সালের ১৯ জুলাই গৃহীত হয়। আইনটির নাম দেওয়া হয় �দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট ১৯৭৩।� বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকার বিচারের জন্য প্রসিকিউটর নিযুক্ত করেন। বিদেশ থেকে আইনজীবীও আনা হয়। এত কিছুর পর ঐ সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে অকস্মাৎ সরে দাঁড়ায়। ১৯৭৩ সালের আইন প্রণয়নের পরও মুজিব সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। এই দুই বছর তারা বিষয়টি নিয়ে আর অগ্রসর হয়নি। কেন হয়নি? ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং একটানা ৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। কেন বিচার করেননি? বলা হচ্ছে �৭৩ সালের আইনটিতে অনেক ভুল ও অসংগতি আছে। আইনটি মৌলিক মানবাধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক। এটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্নও নয়। সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া পত্র-পত্রিকার কাটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে যেকোনো ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া যাবে, যা আইনের শাসনের লঙ্ঘন।

খ. আইনটি প্রণীত হয়েছে ৩৬ বছর আগে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে অপরাধ আইনে অপরাধের বিচার চলছে, এসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে শতবর্ষ আগে। সিআরপিসি আইন (১৮৯৮ সালে) এবং যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য সংবিধান সংশোধন করে প্রণীত বিশেষ আইন এক পর্যায়ভুক্ত নয়। এ ধরনের বিশেষ আইনের সাথে সম্পর্ক থাকতে হবে হাল আমলে সংঘটিত ঘটনাবলীর। এই ধরনের একটি আন্তর্জাতিক আইন কার্যকর হয়েছে হল্যান্ডের রাজধানী দি হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে। এই আদালতে ২০০২ সালের ১ জুলাই যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত একটি আইন গৃহীত হয়। ঐ আইনে বলা হয়েছে যে, ২০০২ সালের ১ জুলাইয়ের আগে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেসব অপরাধের বিচার এই আইনের অধীনে হবে না। ২০০২ সালের ১ জুলাইয়ের পর যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অথবা ভবিষ্যতে হবে, সেইসব অপরাধের বিচার এই আইনের অধীনে হবে। হল্যান্ডের এই আন্তর্জাতিক আইন এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনের মধ্যে রয়েছে বেশ অসঙ্গতি। আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার সাথে �৭৩ এর আইনের সংজ্ঞার কোন মিল নেই।

গ. �৭৩ এই আইন সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের ১ ও ২ উপ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন প্রণীত হওয়ার আগে সংঘটিত অপরাধের যেমন বিচার করা যাবে না তেমনি একই অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একবারের বেশি বিচার করা যাবে না। �৭৩ এর আইন প্রণয়নের আগে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন অফিসার ও জওয়ানকে চিহ্নিত করা হয় (End of a Bad Dream, Weekly Time Magazine, 22 April, 1974)। যাদেরকে সহযোগী বা দালাল বলে প্রচার করা হয়, তাদের বিচার হয় দালাল আইনে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে হোক বা অন্য যে কোনো কারণে হোক, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত পাক সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন সদস্যকে ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে বিচার পর্বের সেখানেই সমাপ্তি ঘটেছে (End of a Bad Dream, Time Magazine, 22 April, 1974)। স্বাধীনতা বিরোধী বলে যাদের অভিযুক্ত করা হয় তাদের বিচার দালাল আইনে হয়ে গেছে। এখন দ্বিতীয়বার তাদের বিচার হবে ন্যায় বিচারের লঙ্ঘন।

ঘ. �৭৩ সালের আইনের ১৯ এবং ২২ নম্বর ধারাটি �প্রিন্সিপল্� অব ন্যাচারাল জাস্টিস� এবং মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই আইন ১৮৯৮ সালের �সিআরপিসি� এবং ১৯৭২ সালের �এভিডেন্স এ্যাক্টের� লঙ্ঘন। ১৯ ধারার ২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৃত ব্যক্তির জীবিতকালে প্রদত্ত জবানবন্দী অথবা বর্তমানে জীবিত, কিন্তু দূরদেশে অবস্থানের কারণে সাক্ষ্য দিতে অক্ষম ব্যক্তির পূর্বে প্রদত্ত জবানবন্দিও বিবেচনা করা হবে।

ঙ. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ১৯৭৩ সালের আইন নিয়ে দেশে-বিদেশে মানবাধিকার কর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সে গত ২০ এপ্রিল এক আলোচনা অনুষ্ঠানে ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিটি অব হাউজ লর্ডসের চেয়ারম্যান লর্ড এরিক এভবারি বলেন, �৭৩ এর আইনে বেশকিছু ত্রুটি রয়েছে, যা আর্ন্তাজাতিক মানের নয় বলে তাদের ধারনা (Daily Star Online, ২১/০৪/২০০৯)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাবেক ডিন, আইন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. এরশাদুল বারী এ প্রসঙ্গে বলেন, সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে ব্যক্তির যে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আইনে তা রহিত করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে কোনো অপরাধের বিচার করা যায় না। এ রকম কিছু হলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই (নয়া দিগন্ত, ২৩/০৪/২০০৯)।

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন সম্প্রতি এই আইনটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন । তিনি দৈনিক প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকারে ১৯৭৩ সালের বিদ্যমান আইনের কার্যকারিতা ও আন্তর্জাতিক মান সম্পর্কে বলেছেন �প্রথমেই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে হবে, ওই আইনে সাজা হয়ে যাওয়ার পর সুপ্রিমকোর্টে আপিল করার অধিকার রয়েছে। বিচারকরা যেহেতু হাইকোর্ট থেকে আসবেন, তার মানে এটা উচ্চ আদালতের সমমানের আদালত। কিন্তু আপিল যথেষ্ট কি না, তা নিয়ে সন্দেহ উঠবে। আবার ১৯৭৩ সালের আইন নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এটা ৩৮ বছর আগে যতটা আধুনিক ছিল, এখন ততটা নয়। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের আইন বিশ্বে প্রথম। এটার একটি ঐতিহাসিক মূল্য আছে, কিন্তু আজকে স্বচ্ছ বিচারে যে মানদণ্ড দরকার সেই মানে ওটা পৌঁছায় কি না সেটা দেখতে হবে। তার জন্যই আইনকে ভালো করে পর্যালোচনা করতে হবে।� (প্রথম আলো, ০৫/০৪/২০০৯)
তিনি আরও বলেন, ১৯৭২-৭৩ সালেই এই বিচার করে ফেললে এত সমস্যা হতো না। কিন্তু আজকে মানুষের চিন্তাচেতনা পাল্টে গেছে, আজকে মানুষ মানবাধিকার সম্পর্কে অনেক সচেতন হয়েছে। তাই আজকের মান অর্জন করতেই হবে। যে মুহূর্তে আমরা বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করব, তখন থেকেই আন্তর্জাতিক দৃষ্টি এর ওপর এসে পড়বে। যে মুহূর্তে মনে হবে এটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অর্জন করছে না, সেই মুহূর্তে নানা জায়গা থেকে চিৎকার আসতে থাকবে। আমরা বেকায়দায় পড়ে যাব। (প্রথম আলো, ০৫/০৪/২০০৯)

২. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেভাবে করা হবে বলা হচ্ছে এতে অনেক সামাজিক সমস্যার জন্ম দিতে পারে। বিশেষ করে গ্রাম গঞ্জে বেশ সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। ইতিমধ্যে দেশে বিভিন্ন যায়গায় অনেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রতিপক্ষের মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে। এসব মামলার কতগুলো সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধের মামলা তা বলা কঠিন। কিছু দিন আগে রাজশাহীতে ২ টি মামলাকে যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে মামলা বলে ব্যপক প্রচার করা হলেও পরে দেখা যায় সেগুলো ছিল জমিজমা সংক্রান্ত পারস্পারিক বিরোধের মামলা। এভাবে যুদ্ধাপরাধের বিষয়টা ব্যাপক ভাবে প্রতিপক্ষ ঘায়েলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহ্রত হতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু বিএনপি জামায়াতের নেতা কর্মীই নয়, আওয়ামীলীগের অনেক স্থানীয় নেতা কর্মীরাও প্রতিহিংসার স্বীকার হতে পারেন, যা আওয়ামীলীগের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। এসব সামাজিক অস্থিরতার কথা চিন্তা করে হয়তো সরকার বিচার থেকে পিছু হটতে চাইছে।

৩. হতে পারে, সরকার বিষয়টি নিয়ে আরও হোম ওয়ার্ক করতে চায়। তথ্য সংগ্রহের জন্য আরও সময় নিতে চায়। যেহেতু সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং, প্রকাশিত ভিডিও-অডিও, বইপত্রের ওপর ভিত্তি করা হবে, সেজন্য এসব আরো ব্যাপক ভাবে সংগ্রহের জন্য আরও সময় নিতে চায়। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সরকার আমেরিকার ২ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের উপর পরিচালিত গবেষনাকর্ম থেকে তথ্য সাহায্য নেবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ড. নুরুন্নবী সহ সমমনা কিছু বুদ্ধিজীবিদের প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্টের কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশে গনহত্যার উপর মাস্টার্স কোর্স সহ বেশ কিছু গবেষনা কর্ম হাতে নেওয়া হয়। কিন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদী গনহত্যার উপর পরিচালিত গবেষনার অন্যতম সূতিকাগার (সমকাল, ০৮.০১.২০০৮)।

৪. অনেক বলছেন, সরকার ভুলেই হয়তো একসাথে অনেক কাজে হাত দিয়েছে। পিলখানা হত্যা কান্ডের বিচার, খালেদা জিয়ার বাড়ী, মাদ্রাসা ও জঙ্গীবাদ ইস্যু, বিদ্যুতসহ নানাবিধ সমস্যা এখন সরকারের সামনে। ১/১১ আগে ও পরে বাংলাদেশের রাজনীতি সহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেশী-বিদেশি থিংক ট্যাংকের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার প্রভাব ব্যাপক ভাবে লক্ষ্যনীয়। এ সরকারের পিছনেও বেশ কিছু দেশী-বিদেশি থিংক ট্যাংক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। তাদের পরামর্শে হয়তো এতোগুলো কাজ একসাথে সামাল দেওয়া সম্ভব না বলেই সরকার আপাতত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটা পিছাতে চাচ্ছে।

৫.ইতিমধ্যে মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের নাম বলা হচ্ছে প্রায় সকলেই কোন না কোন ইসলামী সংগঠনের নেতা কর্মী । ফলে এসব সংগঠন মুসলিম বিশ্বে আওয়ামীলীগ সরকার বিরোধী প্রচারনা চালাতে পারে। উল্লেখ্য, একটি ঐতিহাসিক পটভুমিতে বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন পাকিস্থানি সেনাসহ তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে সাধারন ক্ষমা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এটা করা হয়েছিল। এবারও ঠিক একই ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বে কি কি প্রভাব পরতে পারে তার একটা ধারনা করা যেতে এভাবে,

ক. যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ইতিমধ্যে মিডিয়ার মাধ্যমে যাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে তাদের বেশীর ভাগ জামায়াতের প্রথম সারির নেতা। এদের বাইরে আরও কিছু্ ইসলামী ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা হয়েছে। এদের মধ্যে জামায়াত ঘরনার বাইরের আলেম হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালী আলেম মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান অন্যতন। তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি নিজ এলাকা কিশোরগঞ্জ জেলায় যুদ্ধাপরাধের মামলা হয়েছে। তিনি মুসলিম বিশ্বের সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান সৌদি আরব ভিত্তিক রাবেতা আল আলমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বাংলাদেশ থেকে মনোনীত একমাত্র সদস্য। এর সাথে যোগ হতে পারে সরকারের কিছু মন্ত্রীর মাদ্রাসাযে শিক্ষা বিরোধী মন্তব্য। জামায়াতের সমালোচক হিসেবে পরিচিত আলেম সমাজ বিশেষত কওমী মাদ্রাসা সরকারের বিরূদ্ধে চলে গেলে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারে ভেবেই হয়ত প্রধানমন্ত্রীর সৌদি সফরের আগে কওমী মাদ্রাসার একটি গুরুপের সাথে তড়িঘড়ি করে বৈঠক করেন। সরকারের শুরুতে আলেম সমাজ সরকার বিরুধী অবস্থানে চলে গেলে তারা দেশে বিদেশে বিশেষত মুসলিম বিশ্বে এ সরকারকে ইসলাম বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পাবে।

খ. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটি খুব স্পর্শকাতর। এখানে পাকিস্তানের বিষয়টি জড়িত। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন মূল অপরাধী ছিল পাকিস্থান সামরিক বাহিনীর সদস্য। মূল অপরাধীদের বাদ দিয়ে শুধু মাত্র সহযোগীদের বিচার কতটুকু গ্রহনযোগ্য হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। এ ক্ষেত্রে সরকারকে পাকিস্থানের সঙ্গে বাদানুবাদে যেতে হবে। সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভাল। এ ইস্যু নিয়ে নতুন করে কিছু আবার হোক, সৌদি আরবের কাছে তা কোনোভাবে ভালো লাগবে না।

গ. প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় তার প্রকাশিত থিসিসে (Harvard International Review Online Version, 19 Nov 2008) বাংলাদেশ মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ বিস্তারে সৌদি আরব, কুয়েতসহ মুসলিম বিশ্বের অর্থায়নকে যেভাবে সরাসরি দায়ী করেছেন, তাতে সৌদি আরব সহ মুসলিম বিশ্বে আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে একটা বিরুপ ধারনার সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশ মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ সৃষ্টিতে সৌদী অনুদান ভূমিকা পালন করছে, এ অজুহাতে পশ্চিমা সরকার ও প্রচার মাধ্যম গুলো দেশটি সম্পর্কে আরো ব্যাপক প্রচারনার সুযোগ নিতে পারে। এটা সৌদি সরকার ভাল ভাবে নাও নিতে পারে।

ঘ. বর্তমানে সারা বিশ্বে চলছে আর্থিক মন্দা। প্রতিদিনই বিদেশ থেকে শত শত শ্রমিক দেশে আসছে, যাদের পাঠানো রেমিটেন্সই বাংলাদেশের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিকদের সিংহভাগই আছেন মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে। সুতরাং অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারনেই এ মুহুর্তে মুসলিম দেশসমুহের সাথে সম্পর্ক শীতল করতে সরকার ইচ্ছুক হবে না। অতিতের অনেক দূর্যোগেই সৌদী আরব সহ অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সাহায্য সহযোগিতাই ছিল প্রধান। এবার ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় পশ্চিমা দেশগুলো থেকে সাহায্য সংকুচিত হওয়ায় মুসলিম প্রধান ধনী দেশগুলোর দিকেই তাকাতে হতে পারে সরকারকে। সামগ্রিক বিবেচনায় তাই মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি সরকার চাইবে না। অন্তত পক্ষে অর্থনৈতিক কারনে।

ঙ. তবে সরকার, আওয়ামীলীগের থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত দেশি বিদেশি মহল বসে নেই। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের চাপ একটি অন্যতম প্রধান ইস্যু হতে পারে ভেবে অনেক আগে থেকেই এ ব্যাপারে প্রস্তুতি মূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আরব বিশ্বের জনমত গঠনে আল জাজিরা টিভির প্রভাব ব্যপক। কে এক্ষেত্রে গত বছর এই মিডিয়াকে বেশ সফলভাবে কাজে লাগানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ও চ্যানেল আই এর সহযোগিতায় বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি নিয়ে আল জাজিরার কভারেজ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম তথা বিবিসি সিএনএন এর চেয়েও ছিল ব্যাপক। এছাড়া মুসলিম বিশ্বের আরেকটি প্রভাবশালী অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ইসলাম অনলাইন ডট নেটেও জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচার চালানো হয়। মনে করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সৌদী সফরে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সফরসঙ্গী হওয়ার পেছনে মূল কারন ছিল সৌদী সরকারের মনোভাব সরাসরি বুঝে উঠা। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করে পাঠানো হচ্ছে বলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ।

৬. অনেকে এটাও বলছেন, আওয়ামীলীগ এই সমস্যাটির সমাধান তাড়াতাডি না করে রাজনৈতিক স্বার্থেই এটিকে জিইয়ে রাখতে চায়। ৯২-৯৪ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নামে পরিচালিত জামায়াত বিরোধী আন্দোলন দিয়ে আওয়ামীলীগ বেশ লাভবানও হয়। ফলত ৯৬ এর নির্বাচনে জামায়াতের ভরাডুবি ও আওয়ামীলীগের সরকার গঠন সহজ হয়। একই ভাবে ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবি ও প্রচার মাধ্যমের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক ব্যাপক প্রচারনায় আবারও জামায়াতের ভরাডুবি ও আওয়ামীলীগের ব্যাপক বিজয় হয়। সুতরাং রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত এমন একটি মোক্ষম হাতিয়ার আওয়ামীলীগ এত সহজেই শেষ হোক তা চাইবে না।

৭. গত ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকেই চার দলীয় জোটের প্রধান দুই শরিক বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে শীতল সম্পর্ক বিরাজমান। নির্বাচনোত্তর বিএনপি নেতা কর্মীদের উপর হামলা, খালেদা জিয়ার বাড়ি ইস্যু সহ বিভিন্ন সরকারী চাপে এখন বিএনপি। দলটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চাচ্ছে সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে নামতে। এক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু তীব্রতর হলে জামায়াতও চাইতে পারে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামতে। সেক্ষেত্রে নানান টানাপোড়েনের পরেও বিএনপি জামায়াত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সময়ের ব্যপার মাত্র। সরকার হয়তো চাইবে না তাদের মেয়াদকালের শুরুতেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক।

Aucun commentaire:

Enregistrer un commentaire